কোনওরকম অস্ত্র ছাড়াই বিনা রক্তপাতে এত বড় ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাপারটা কী ইন্টারেস্টিং লাগে না! তার উপর সেই ব্যাংক ডাকাতির সাথে যদি কোন ভাবে ডার্ক ওয়েবে যুক্ত থাকে তাহলে আমাদের ইন্টারেস্ট আরও বেড়ে যায়। আজকে সেরকম একটা বিশাল বড় ব্যাংক ডাকাতির কথা বলব, যার সাথে টেকনোলজি ভীষণভাবে যুক্ত। ব্লগটি ইন্টারেস্টিং হবে ও আপনাদের ভালো লাগবে।
কিভাবে সম্পূর্ণ হলো এই ব্যাংক ডাকাতি?
দিনটা ১১ আগস্ট ২০১৮ সাল বিকেল পাঁচটার সময় যখন ব্যাংক ছুটি হওয়ার ঘণ্টা বেজে গেছে প্রায় সেই সময় কসমস ব্যাংকর এক কর্মচারীর কাছে একটা টেলিফোন আসলো। তাদেরই এক গ্রাহক ফোন করে বলছেন যে, এটিএম থেকে তিনি যখন টাকা তুলতে যাচ্ছেন তখন সেই গ্রাহক দেখছেন তার অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা আছে। যদিও গ্রাহক জোরের সাথে বলেন যে, তার অ্যাকাউন্টে ₹1,50,000 টাকার বেশি থাকার কথাই নয়। অবশ্যই সন্দেহজনক খবর, তাই ব্যাংকের কর্মচারী ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না।
তিনি ভাল করে সিস্টেমে চেক করলেন, কোন প্রকার সমস্যা খুজে পেলেন না। তাই তিনি মনে করলেন ওই গ্রাহক, হয় মজা করছেন অথবা তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে অথবা এটিএম মেশিনের কোনও সমস্যা। কারণ ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ₹1,50,000 টাকাই আছে। কোনও কোটি কোটি টাকার গল্প নেই। ব্যাংক কর্মচারী আপাতত এই ব্যাপারটা সোমবার এর জন্য মুলতুবি থাক বলে, ব্যাংক বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন৷
পরের দিন ব্যাংকের ছুট, রবিবারের ছুটি উইকেন্ড এবং সেই দিনই হল সবথেকে বড় ঘটনাটা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সব থেকে বড় ব্যাংক ডাকাতি। সেদিন প্রায় ₹94,00,00,000 টাকার ব্যাংক ডাকাতি করা হয়। রবিবারের দিন কসমস ব্যাংকর বিভিন্ন এটিএম কাউন্টার থেকে ₹80,00,00,000 টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হল এবং আরও ₹14,00,00,000 কসমস ব্যাংক থেকে সুইফ্ট ট্রান্সকশনের মাধ্যমে হংকংয়ের একটি ব্যাংকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হল।
ছবিঃ সংগৃহীত |
সোমবার নতুন কর্ম সপ্তাহের প্রথম দিন কসমস ব্যাংকের কাছে একটি ফোন আসলো সুইফট এর কাছ থেকে, যে এরকম বড় ট্রানজেকশন হয়েছে। যেটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু সেরকম ট্রানজেকশন কসমস ব্যাংকের সাধারণত হয় না। এত বড় ট্রানজেকশন তো হয়-ই না। এর পর ভিসার তরফ থেকে, রূপের তরফ থেকে বিভিন্ন রকম খবর আসলো যে কসমস ব্যাংকের এটিএম থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা তোলা হয়েছে এবং তার সংখ্যাটা তার পরিমাণটা বিশাল বড়। কসমস ব্যাংকের কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন।
14 তারিখ, হ্যা 12 তারিখ চুরি হয়েছে 13 তারিখে ঘটনা ঘটছে তারা সব হিসেব মিলিয়ে 14 তারিখে পুণের পুলিশ স্টেশনে কমপ্লেন করলেন। যে তাদের ব্যাংক থেকে ₹94,00,00,000 টাকা গায়েব হয়ে গেছে। তদন্তের দায়িত্ব পড়ল জ্যোতিপ্রিয়া সিং এর হাতে। তিনি তখন মহারাষ্ট্রের পুনের একজন কমিশনার পদে রয়েছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বা এরকম কিছু।
ছবিঃ সংগৃহীত |
আর পুলিশ সত্যিই তারপর মন দিয়ে তদন্ত করল। আর পুলিশ যদি চায় কি না করতে পারে। নয় লাখের ওপর মোবাইল কলকে ট্রেস করা হল। বিভিন্ন এটিএম ট্র্যানজ্যাকশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হল। সি সি টিভি ফুটেজ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কালেক্ট করা হল এবং তার পর 18 জনকে গ্রেফতার করা হল। এই 18 জন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, যে মূল চক্র টা তার পাণ্ডার নাম সুমের ইউসুফ শেখ। তবে সুমের ইউসুফ শেখ তিনি যে আসলে মাস্টারমাইন্ড নন তার উপরে কেউ আছে সেটা ক্রমশ পরে জানা যায়। এই সম্পূর্ণ ঘটনাতে মহারাষ্ট্র পুলিশের একজন কনস্টেবল কিন্তু খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি আসলে ইন্ডিয়ান আর্মির একজন রিটায়ার্ড অফিসার। তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে সেইসব সাইবার অপরাধের ব্যাপারে বিভিন্ন ট্রেনিং পেয়েছিলেন এবং তার সেই নলেজ কাজে লাগে মহারাষ্ট্র পুলিশের।
ছবিঃ সংগৃহীত |
পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, এই সুমের ইউসুফ শেখ এই ব্যক্তি চেন্নাইয়ের ইউনিয়ন ব্যাংকে ফ্রড করার চেষ্টা করেছিল এর আগে। তার জন্য সে ধরাও পড়েছিল। কিন্তু চেন্নাইয়ের সিটি ইউনিয়ন ব্যাংকের সেই কেস বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে। সেই ব্যক্তি মুক্তিও পেয়েছে। এবার সেই ব্যক্তিই কোনও ভাবে এই জালিয়াতিটা করেছে।
তদন্ত করে দেখা গেল যে, এই ডাকাতির প্ল্যান শুরু হয়েছিল কবে থেকে কেউ জানে না। তবে নজরদারি করা শুরু হয়েছিল সাত মাস আগে থেকে। সাত মাস আগে কসমস ব্যাংকের বিভিন্ন অফিসারের কাছে একটা মেইল আসে। সে মেইলটা দেখতে নিরীহ হলেও সেই মেইলের মধ্যে একটি লিঙ্ক ছিল। সেই লিঙ্কে ক্লিক করলে একটা ম্যালওয়্যার তার কম্পিউটারে ইন্সার্ট হয়ে যেতে পারত। এত জনকে সেই মেইল পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল যে, কেউ না কেউ তো সেই লিঙ্কে ক্লিক করবে এবং শেষ অবধি হয়েছিলও তাই কেউ না কেউ সেই লিঙ্কে ক্লিক করেছিল এবং একটা ম্যালওয়্যার কসমস ব্যাংকের এটিএম সার্ভারে ইনস্টল হয়ে গিয়েছিল। সাত মাস ধরে সে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কিন্তু এই সাত মাসে কি কিছু হয়নি। এই সাত মাসে অনেক কিছু হয়েছে৷ এই সাত মাসে ইউসুফ শেখ তিনি একটা দল গঠন করেছেন। আসলে একটা নয় তিনি একাধিক দল গঠন করেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ছোট ছোট শহরের ছোট ছোট দল।
ছবিঃ সংগৃহীত |
সেই দলে কারা ছিলেন?
সেই দলে ছিলেন নিরীহ মানুষ। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, দিন মজুর, চাষি তারা ছিলেন সেই দলে। তারা এ সব ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তাদের আসলে সাধারণ কাজে লাগানো হয়েছিল এটিএম কাউন্টার থেকে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা তোলার জন্য। আর এখানেই ডার্ক ওয়েবে যুক্ত।
জানা যায় যে, কসমস ব্যাংকের সাড়ে চারশোর মতো গ্রাহকের তথ্য ও এটিএম কার্ডের তথ্য বা ডেবিট কার্ডের তথ্য কিনেছিলেন। ডার্ক ওয়েবে এরকম কিনতে পাওয়া যায়। এটিএম কার্ডের বা ডেবিট কার্ডের তথ্য কেনার পর, তিনি নকল এটিএম কার্ড বা ক্লোন এটিএম কার্ড তৈরি করে এবং সেই কার্ডগুলো পৌঁছে দেওয়া হয় বিভিন্ন সাধারণ মানুষের কাছে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল এটিএম কার্ডের তথ্য কিনতে পাওয়া গেল, ক্লোন কার্ডও তৈরি করা হল, কার্ডের তো পিন জানা নেই? কার্ড যদি মেশিনে ঢোকানো হয় তাহলে সাথে সাথে ব্যাংক সেটাকে রিজেক্ট করে দেবে। কিন্তু সেটাকেও বাইপাস করার জন্যই শুরুতে ম্যালওয়্যারের কথা বলেছিলাম সেটা ঘাপটি মেরে বসেছিল এটিএম সার্ভারে।
ছবিঃ সংগৃহীত |
আসলে এখানে আপনাকে বুঝতে হবে যে এটিমের ব্যাপারটা কী ভাবে কাজ করে?
আমরা যখন এটিএম মেশিনে এক কার্ড ঢোকাই, সেই মেশিনটা এটিএম সার্ভারে মানে ব্যাংকের যে এটিএম সার্ভার আছে সেখানে সিগন্যাল পাঠায়, পারমিশন চায় যে টাকা দেওয়া হবে কিনা। ব্যাংকের এটিএম সার্ভার দেখে যে, ওই কার্ডটা কোন কোম্পানির কার্ড। ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ড, রূপে কার্ড সেটা দেখার পর যদি ভিসা কার্ড হয় তাহলে ভিসার কাছে অ্যাপ্রুভালের জন্য পাঠায় অথবা মাস্টারকার্ড হলে মাস্টারকার্ডের কাছে তাদের সার্ভারের কাছে অ্যাপ্রুভালের জন্য পাঠায়। যখন মাস্টারকার্ড বা ভিসা কার্ড সেটা মিলিয়ে বলে যে হ্যা, এটা আমাদের কার্ড সব ঠিকঠাক আছে। কোনও গণ্ডগোল নেই তখন সেই অ্যাপ্রুভাল টা নিয়ে এটিএম সার্ভার, ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে সেটাকে পাঠান। এবার ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম যখন পুরো ব্যাপারটা দেখে বলে যে, হ্যা সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকাও আছে, তো একে টাকা দিয়ে দেওয়া হোক। সেই সিগন্যালটা আবার এটিম সার্ভারের কাছে আসে। এটিএম সার্ভার এই পারমিশন টা পেয়ে সেটা এটিএম মেশিনকে জানিয়ে দেয়। এটিএম মেশিন টাকা বার করে দেয়। অর্থাৎ মাঝখানে ওই এটিএম সার্ভার মিডলম্যানের মতো কাজ করছে এবং তার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে ম্যালওয়্যার।
এবার যখন একই সাথে ১২-ই আগস্ট রবিবার দিন একসাথে 12,000 এটিএমে 12,000 জন মানুষ টাকা উইথড্র করার জন্য নকল ডেবিট কার্ড ঢোকালো তখন এটিম সার্ভারের কাছে সিগন্যালে গেল। কিন্তু এটিএম সার্ভার আর ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের কাছে সিগন্যালে পাঠাল না। ম্যালওয়্যার সেখান থেকেই অর্থাৎ এটিএম সার্ভার থেকেই পারমিশন দিয়ে দিল। এটিএম মেশিনকে যে এদেরকে টাকা দিয়ে দেওয়া হোক এবং এইভাবে ₹80,00,00,000 টাকা বিভিন্ন এটিএম কাউন্টার থেকে উদ্ধার করা হল। একই দিনে একই সময়ে।
পুলিশের তদন্তে কিন্তু সুমের ইউসুফ শেখ ধরা পড়লেন না। এমনকী জানা গেল না তার পিছনে মাস্টারমাইন্ড কে আছে। তবে হ্যা, সাধারণ মানুষ যারা ছিলেন যাদের ব্যবহার করা হয়েছিল তারা কিন্তু ধরা পড়লেন। বিচারে তাদের শাস্তিও হলো চার বছর সাত মাস জেলের শাস্তি ।
ছবিঃ সংগৃহীত |
চুরির টাকা উদ্ধার হয়েছে কি?
পুলিশ সাড়ে চার থেকে ৫ কোটি টাকার মত উদ্ধার করতে পেরেছে শেষ অবধি। কিন্তু বাকি টাকার আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।
সন্দেহ করা হয় যে, এই গোটা চক্রের পিছনে ছিল নর্থ কোরিয়ার হ্যাকাররা। কিন্তু সন্দেহ করে লাভ কি। শেষ পর্যন্ত তো কাউকে ধরা যায়নি। মূল চক্রীর কাছে পুলিশ শেষ অবধি পৌছাতে পারেনি সেটা পুলিশের সাফল্য বলব না, ব্যর্থতা বলব আপনারাই বিচার করুন, পুলিশ সত্যিই তদন্ত করেছিল, খেটেছিল ছিল কিন্তু শেষ অবধি তদন্ত পুরোপুরি সফল হয়েছে এই কথা বলা যায় না।
আমি আপনি আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের তথ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রায়ই বলি যে আমার মোবাইলে এমন কী তথ্য আছে যদি চুরি করে নেয় যদি হ্যাক করে নেয় কী যায় আসে। আসলেও যায় আসে বারবার প্রমাণ হয়ে যায়। এর আগে আপনাদের টেক নিউজে বলেছিলাম যে একজন 14 বছরের বাচ্চার তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার ফলে, সেই গোটা পরিবারকে কী ভাবে হেনস্থা হতে হয়েছিল? তাদের বাড়ি থেকে উৎখাত হতে হয়েছিল। তার বাবা আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। কি জানে না সে খবর? টেক নিউজগুলো জানার জন্য আমাদের আর্টিকেল গুলো নিয়মিত দেখুন ও পড়ুন।
Naiem
উত্তরমুছুনআপনাদের মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই অবশ্যই আপনার মতামত প্রকাশ করতে আমাদের কমেন্ট বক্স ব্যবহার করুন......