এই মুহূর্তে আপনি বাংলাদেশ এক মার্কিন ডলার ভাঙ্গান তবে পাবেন ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা আর ওই একই মার্কিন ডলার যদি আপনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ভাঙ্গান তবে সেখানে পাবেন 73 আফগানি মুদ্রা। তার মানে কি? তার মানে হচ্ছে ৫০ বছর যাবত স্বাধীন একটা দেশের মুদ্রার মান টানা ২০ বছর যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং মার্কিন নিপীড়িত থাকা একটা দেশের মুদ্রার মানের তুলনায় অনেক কম। যেখানে এক আফগানিস্থান মুদ্রার মূল্য প্রায় বাংলাদেশি ১.৫০ টাকা মূল্য্যমান।
মূল্যমানের দিক বিবেচনায় আফগানিস্তান কিন্তু পাশের দেশ ভারতীয় রুপির চাইতেও এগিয়ে। মার্কিন সংবাদ ব্লুমবার্গ এর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে গত সেপ্টেম্বরের কোয়ার্টারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মূল্য বৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়া মুদ্রা এটি। যেখানে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ৯ শতাংশ।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, আফগানি মুদ্রা এত ভালো করল কিভাবে? সে দেশের সরকার এক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে। আর মুদ্রার মান বেশি হওয়া মানে কি আফগানিস্তান আর্থিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সে দেশের আসল চিত্রটা কেমন চলুন দেখে আসি আজকের এই লেখনীতে।
আফগানিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে বিশ্বের সকল পরাশক্তি স্থায়ীভাবে খুঁটি স্থাপনের জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন যুদ্ধের পরে আফগানিস্তান থেকে সবাই হেরে পালিয়েছে। যেখানে সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টানা ২০ বছর লড়াই করেও তাদের সৈন্যদল নিয়ে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তান ছেড়েছে।
প্রশ্ন করতে পারেন,
সবাই এখানে প্রভাব বিস্তার করতে চাই কেন?
এক কথায় উত্তর দিলে তা হবে আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। এই দেশটির অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ঠিক পাশেই আবার উপরের দিকে আছে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। মধ্য-প্রাচ্যের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, ইরানের উপর হুমকি তৈরি করা এবং চীন, রাশিয়ার যে সুবিধা জনক স্থান মধ্য এশিয়া, সেখানে প্রভাব রাখার জন্য ভৌগোলিকভাবে আফগানিস্তান একটি বিশেষ জায়গায় অবস্থিত। যে কারণে পশ্চিমা দেশের আগ্রহের স্থান হয়ে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আবার এই আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ লক্ষ কোটি ডলার যেখানে প্রায় ১২,০০০ টির মতো খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। যেখানে সম্পদের মধ্যে রয়েছে সোনা, লোহা, তামা, পেট্রোলিয়াম সহ আরো নানান খনিজ। এত এত সম্পদ থাকার পরেও তার সঠিক ব্যবহার করতে পারেনি, কারণ এতদিন তাদেরকে যুদ্ধ সামলাতে হয়েছে।
২০২১ সালের মে মাসে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে আফগানরা স্বাধীন হয়। ২০২৩ সালে এসে নানা দিক থেকে ভেঙে পড়া এই দেশটি তাদের মুদ্রা মানে চমক দেখালো। প্রথমে একটু জানার চেষ্টা করি যে একটি দেশের মুদ্রা মান কখন এবং কিভাবে বৃদ্ধি পায়।
কাগজের মুদ্রার ততক্ষণ পর্যন্ত কোন দাম বা মূল্য নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না এর বিপরীতে সম্পদ যুক্ত হবে। মনে করেন আপনার কাছে একটা স্বর্ণের বার আছে যেটা কোন একটা জায়গায় জমা রাখলেন এবং এই স্বর্ণের বারের বিপরীতে আপনি ১ লক্ষ কাগজের মুদ্রা নিলেন। মানে আপনি এই ১ লক্ষ কাগজের মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করলেন একটি স্বর্ণের বার। মানুষকে আপনি এই ১ লক্ষ মুদ্রার মধ্য থেকে ১ হাজার মুদ্রা প্রদান করে এর বিনিময়ে আপনি অন্য কোন পণ্য নেন বা দেয় এবং ওই মানুষ এই ১ হাজার মুদ্রার জন্য আপনার রক্ষিত যে স্বর্ণ বার টি রয়েছে সেটির কিছু অংশের মালিক হয়ে যায়। এখন হঠাৎ যদি এমন হয় যে সেই স্বর্ণের বারটি একজন বিদেশী এসে চুরি করে নিয়ে গেছে তাহলে আপনার কাছে থাকা মুদ্রাগুলোর কোন মূল্য থাকবে কি? আসলে এর উত্তর হলো না, কাগজের মুদ্রা গুলো কোন মূল্য থাকবে না। কিন্তু এমন যদি হয় যে আপনার কাছে এক লক্ষ মুদ্রা রয়েছে কিন্তু স্বর্ণের বার একটি থেকে দুটি হয়ে গেছে তাহলে সেখানে আপনার মুদ্রার মান আরো বেড়ে যাবে। একইভাবে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সম্পদের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রার বিপরীতে যদি মার্কিন ডলার থাকে তবে সেই মুদ্রার মূল্য কিন্তু বেশি হয়। কারণ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পেট্রোলিয়ামের মূল্য নির্ধারণ হয় এই ডলারে, তাই ডলারকে সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় দেশে দেশে।
এখন মনে করেন, কোন দেশে যেই পরিমাণ সম্পদ ছিল তার বিপরীতে ওই দেশে এক হাজার পরিমাণে কাগজী মুদ্রা ছিল কিন্তু। কিছুদিনের মধ্যেই যদি সেই দেশের বিভিন্ন কারণে বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলার প্রবেশ করে তাহলে ওই এক হাজার পরিমাণের কাগজি মুদ্রার মান বেড়ে যাবে। কারণটা কি? আপনার ঐ এক হাজার এর বিপরীতে সম্পদের মান বেড়ে গেছে মানে ডলার বেড়ে গেছে। তবে হ্যা, মুদ্রার মান তখনই বাড়বে যখন নতুন করে সেই দেশে আর কাগজে মুদ্রা না ছাপাবেন।
আবার অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল অনেক দেশেই কিন্তু আছে যারা দেশের ট্যাক্স, দ্রব্যমূল্য, পর্যটন আকর্ষণ ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে ইচ্ছা করেই ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার মান কমিয়ে রাখে এবং বেশি করে মুদ্রা ছাপিয়ে রাখে। যেমন ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রার মান বাংলাদেশি মুদ্রার তুলনায় প্রায় ১৩০ গুণ কম এর মানে কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ নয়। বরং সে দেশ সচেতনভাবেই হয়তোবা করেছে কারণ সে দেশের ডলারের প্রবাহ অনেক বেশি বিশেষ করে পর্যটন খাতের জন্য। তার মানে কোন মুদ্রার মূল্যমান ডলার বা সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য বাড়ে।
এবার চলুন আফগানিস্তানে কি হয়েছে সেটা একটু দেখি
প্রথম ব্যাপারটা হচ্ছে ক্রমাগত মানবিক সহায়তা এসেছে আফগানিস্তানে। ২০২২ সালের মাঝা-মাঝি সময় থেকেই বিভিন্ন বৈষিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে আফগানিস্তান মানবিক সহায়তা পেতে থাকে বা আসতে থাকে। যা আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে একটা শক্তি যুগিয়েছে। ২০২২ সালের সৌদি আরবের পক্ষ থেকে প্রায় ৩ কোটি ডলার সহায়তা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয় ৩২৭ মিলিয়ন ডলার এরকম আরো বহু সহায়তা পেয়েছিল আফগানিস্তান। তবে খুব সম্ভবত আবার মানবাধিকার এবং নারী অধিকারের ইস্যুতে এসব সহায়তা কিছুটা কমে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আফগান মুদ্রার মান বৃদ্ধির পেছনে এইসব সহায়তা যথেষ্ট কাজে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আফগানিস্তানের মানুষজন দিন দিন এই বৈদেশিক সহায়তার উপরে নির্ভরশীল হতে শুরু করেছে যা আগামী দিনগুলোর জন্য কিন্তু আফগানদের অনেক ভোগাবে।
দ্বিতীয়ত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আফগানিস্তানের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অল্প পরিসরে হলেও আফগানিস্তান তাদের বাণিজ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে শুরু করেছে যা আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করছেন। তবে এই জায়গায় সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা মুদ্রা মান বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সিদ্ধান্ত গুলো কি কি?
কিছুদিন আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের স্থানীয় লেনদেনের জন্য মানুষ ডলার এবং পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার করত। যেটা আফগানি মুদ্রা কে সব সময় দমিয়ে রাখত। কিন্তু সরকার এইসব লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে, মানে লেনদেন করার জন্য আফগানি মুদ্রাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। সেই সাথে দেশ থেকে যেন কেউ ডলার নিয়ে বাহিরে না যেতে পারে অর্থাৎ ডলার পাচার করতে না পারে সেই বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত জারি করেছে। দেশে অনলাইন বাণিজ ও অনলাইনের কেনাকাটা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
এই পুরো ঘটনা গুলোর কারণেই আফগান মুদ্রার ব্যবহার বাড়ছে। দেশ থেকে ডলার বাহিরে যেতে দিচ্ছে না বলে আফগান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের পরিমাণ বাড়ছে। আর ডলারের পরিমাণ বাড়ছে মূলত বৈদেশিক সহায়তার কারণেও যে কারণে আফগান মুদ্রার মূল্যমান বেড়ে গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে,
মুদ্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে তার মানে কি আফগানিস্তান অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে?
বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধি পেলেও আফগানিস্তানের দরিদ্রতা কমেনি। ইউএনডিপি এর রিপোর্টে দেখা গেছে এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১.৩% থাকলেও ২০২৪ সালে এটি বাড়বে ০.৪ % হারে। মাথাপিছু আয় ২০২২ সালে যেখানে ছিল ৩৫৯ ডলার সেটা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়াবে ৩৪৫ ডলার। আর এর মধ্যে যদি নারী অধিকার ও মানবাধিকার ইস্যুতে যদি বৈদেশিক সহায়তা আসা কমে যায় তবে দেশটি কিন্তু চরম দারিদ্রতার মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার কারণে আফগানিস্তান মানুষদের মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার উপরে নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে।
২০২০ সালে ত্রানের উপর নির্ভরশীলতা মানুষের সংখ্যা যেখানে ছিল ৯.৪ মিলিয়ন যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮.৩ মিলিয়নে। তার মানে বৈদেশিক সহায়তা এবং দেশের ভিতর থেকে ডলার বের হতে না দেওয়াই আফগানি মুদ্রার মান বেড়েছে ঠিক আছে কিন্তু ওই সহায়তার অর্থ দেশের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগেনি। বরং নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে। যা অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানকে আরো সংকটে ফেলতে পারে।
তবে আফগানিস্তান সরকার দেশে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বিনিয়োগ আহবান করেছে বিশ্ববাসীর কাছে। যেখানে চীন বা এশিয়ার কিছু দেশ বিনিয়োগে যাওয়ার জন্য সহমত পোষণ করেছেন। যদি প্রাকৃতিক সম্পদ গুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিষয়ে দেশের জনগণকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তবেই আফগানিস্তান অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
সাময়িক মুদ্রা মান বৃদ্ধি হয়তো তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে সম্প্রতি যুদ্ধ থেকে মুক্ত একটা দেশ এত অল্প সময়ে মুদ্রা মান বেড়ে যাওয়াটা কিন্তু খারাপ কিছু না। আশা করি পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।
আপনাদের মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই অবশ্যই আপনার মতামত প্রকাশ করতে আমাদের কমেন্ট বক্স ব্যবহার করুন......